আহমদ গিয়াস, কক্সবাজার ::
একটি গুঁইসাপ, শিয়াল অথবা একটি পেঁচা বছরে পরিবেশগত যে সেবা দিয়ে থাকে তার অর্থনৈতিক মূল্য প্রায় ২৫ লাখ টাকা। মাত্র ১০ বছর বয়সী একটি তেঁতুল গাছ যে অক্সিজেন উৎপাদন করে তা ১৫০ জন মানুষের জন্য যথেষ্ট। উদ্ভিদ বিজ্ঞানের ভাষায় নিম গাছ হল পলিউষন ক্লিনার, যে দূষিত বাতাসকে পরিশুদ্ধ করে। রোহিঙ্গা ক্যাম্প তৈরি করতে গিয়ে ৮ হাজার একর বনাঞ্চলের এই ধরনের হাজার হাজার বৃক্ষ ধ্বংস হয়েছে, বিভিন্ন প্রাণীকুল হারিয়ে গেছে। আর হারিয়ে যাওয়া কয়েকশত প্রজাতির প্রাণীর মধ্যে যদি গুঁইসাপের মত কেবল একটি প্রজাতির প্রাণীর সংখ্যা একর প্রতি একটা করে ৮ হাজারও ধরা হয়, তাহলে বছরে পরিবেশগত ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়ায় ২ হাজার কোটি টাকা।
বাংলাদেশে ১৩৮ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী, ৭১২ প্রজাতির পাখি, ১৯৯ প্রজাতির উভচর ও সরীসৃপ এবং ২৫৩ প্রজাতির স্বাদু পানির মাছ, ৪৭৫ প্রজাতির সামুদ্রিক মাছ ও ১৪৮ প্রকার প্রজাপতি রয়েছে। খাদ্য শৃঙ্খলের কারণে প্রকৃতিতে বিভিন্ন প্রাণীর বৈচিত্র্যময়তা মানুষের বেঁচে থাকার স্বার্থে অপরিহার্য হিসাবে বিবেচনা করেন বিজ্ঞানীরা।
রাজধানীর একটি বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞানের প্রফেসর রাগিবউদ্দিন আহমদ বলেন, আমরা প্রকৃতিতে একটি সাপ, একটি শিয়াল অথবা একটি পেঁচার পরিবেশগত সেবার অর্থনৈতিক মূল্যায়ন করি, তাহলে এর মূল্য দাড়ায় বছরে ২৫ লাখ টাকা। এখন হারিয়ে যাওয়া কয়েকশত প্রজাতির প্রাণীর মধ্যে যদি একটি গুঁইসাপ প্রজাতির প্রাণীর সংখ্যা ৮০০০টিও ধরা হয়, তাহলে পরিবেশগত অর্থনীতির মূল্যায়ন সূত্র অনুযায়ী কেবল এই এক প্রজাতির প্রাণীর হারিয়ে যাওয়ার কারণে পরিবেশগত ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়ায় বছরে ২০০০ কোটি টাকা।
তিনি জানান, পরিবেশে প্রত্যেক প্রাণীর উপস্থিতি মানুষের অস্তিত্বের জন্যই খুব গরুত্বপূর্ণ হলেও ইঁদুরের মত অনিষ্টকারী প্রাণীর নিয়ন্ত্রণহীন ভাবে বেড়ে গেলে তা মানুষের জন্য হুমকী হয়ে ওঠে।
তিনি বলেন, একটি ইঁদুর প্রতিদিন গড়ে ২শ’টি করে ধানের শীষ কাটে। আর একটি গুঁইসাপ, পেঁচা অথবা একটি শিয়াল প্রতিদিন গড়ে ৫০টি করে ইঁদুর শিকার করে। এদের প্রধান খাদ্য ইঁদুর। এভাবে অন্যান্য প্রাণীরও স্ব স্ব কার্যক্রম রয়েছে, যা মানুষের বেঁচে থাকার জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ।
পরিবেশ বিজ্ঞানীরা জানান, উদ্ভিদ বিজ্ঞানের ভাষায় নিম গাছ হল পলিউষন ক্লিনার, যে দূষিত বাতাসকে পরিশুদ্ধ করে। আর মাত্র ১০ বছর বয়সী একটি তেঁতুল গাছ যে পরিমাণ অক্সিজেন উৎপাদন করে তা ১৫০ জন মানুষের জন্য যথেষ্ট। একজন মানুষের অক্সিজেনের জন্য ২৫ বর্গফুটের উদ্ভিদ আচ্ছাদন প্রয়োজন। বৃক্ষ শুধু অক্সিজেন উৎপাদন করেনা, দূষিত কার্বনও শোষণ করে।
তবে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের কারণে হারিয়ে যাওয়া বনের কার্বন শোষন ও অক্সিজেন উৎপাদন মূল্যায়ন এবং পশু-পাখিসহ অন্যান্য প্রাণীর হারিয়ে যাওয়ার সংখ্যাও এখনও নিরূপণ করা সম্ভব হয়নি বলে জানান কক্সবাজার দক্ষিণ বনবিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা হুমায়ূন কবীর।
তিনি জানান, রোহিঙ্গা ক্যাম্পের কারণে বনভ‚মি, বনজ সম্পদ এবং জীববৈচিত্র ও পরিবেশের ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণের জন্য গত ৫ নভেম্বর বনবিভাগের পক্ষ থেকে একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করা হয়েছে। এই কমিটির নেতৃত্ব দিচ্ছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্সটিটিউট অব ফরেস্ট্রি এন্ড এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্সেসের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ কামাল হোসাইন। এছাড়া কমিটিতে আরো রয়েছেন একই বিভাগের প্রফেসর ও বনসম্পদ অর্থনীতি বিশেষজ্ঞ ড. মো. দানেশ মিয়া, ঢাকাস্থ ইস্টওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ও পরিবেশ অর্থনীতি বিশেষজ্ঞ ড. একেএম এনামুল হক। কমিটিতে চট্টগ্রাম অঞ্চলের বন সংরক্ষক আবদুল আউয়াল সরকার ছাড়াও পরিবেশ অধিদপ্তরের প্রতিনিধি, বাংলাদেশ বন গবেষণা ইন্সটিটিউট (বিএফআরআই) চট্টগ্রামের প্রতিনিধি, আন্তর্জাতিক প্রকৃতি সংরক্ষণ সংস্থা (আইইউসিএন) এর প্রতিনিধি ও জেলা প্রশাসনের একজন করে প্রতিনিধিকে রাখা হয়েছে।
এরআগে গত ১৮ অক্টোবর কক্সবাজারে অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদের বন ও পরিবেশ বিষয়ক সংসদীয় কমিটির বৈঠকে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের কারণে ধ্বংস হওয়া বনজ সম্পদ এবং জীববৈচিত্রের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ২৪২০ কোটি টাকা নির্ধারণ করা হয়। এরমধ্যে জীববৈচিত্রের ক্ষতি ১৮২৯ কোটি টাকা এবং বনজ দ্রব্যের ক্ষতি ৫৯১ কোটি টাকা বলে ধরা হয়। কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফে নতুন পুরনো মিলে ৩৪ টি শরণার্থী শিবিরে সরকারের হিসাব অনুযায়ী ১১ লাখ ১৯ হাজার রোহিঙ্গা বসবাস করছে।
বনবিভাগের ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, রোহিঙ্গাদের আশ্রয়ের কারণে ৮ হাজার একর বন ধ্বংস হয়েছে। এরমধ্যে বসতি নির্মাণ করা হয়েছে ৬ হাজার ১৬৪ একরের উপর। আর রোহিঙ্গাদের জ্বালানী কাঠ সংগ্রহের ফলে ধ্বংস হয়েছে আরো ১ হাজার ৮৩৭ একর বনভ‚মি। সেখানে শত বছরের প্রাকৃতিক বন ছিল ৪ হাজার ১৩৬ একর এবং সামাজিক বন ছিল ২ হাজার ২৭ একর।
আর তথ্য প্রকাশের পরই এই পরিসংখ্যান নিয়ে দেশের পরিবেশ অর্থনীতি বিশেষজ্ঞরা ক্ষোভ প্রকাশ করেন। তারা প্রতিবেদনটিকে সম্পূর্ণ অনুমান নির্ভর একটি ভুল প্রতিবেদন বলে আখ্যায়িত করেন এবং এই ধরনের প্রতিবেদনের কারণে পরিবেশ পুনরুদ্ধারে তহবিল সংগ্রহে বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক মহলে সমস্যায় পড়তে হবে বলেও মন্তব্য করেন। পরে সমালোচনার মুখে গত ৫ নভেম্বর একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করা হয়।
কীভাবে এই ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারণ করা হয়েছে জানতে চাইলে কক্সবাজার দক্ষিণ বনবিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মো. হুমায়ুন কবির বলেন, মহেশখালীতে বাস্তবায়নাধীন ‘ইনস্টলেশন অব সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং’ প্রকল্পে যেসব বিষয়ের উপর ভিত্তি করে বন, পরিবেশ ও জীববৈচিত্রের ক্ষতি নির্ণয় করা হয়েছে, সেই পদ্ধতিতেই উখিয়া-টেকনাফে রোহিঙ্গাদের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত বনজ ও জীববৈচিত্রের ক্ষয়-ক্ষতি নির্ধারণ করা হয়েছিল। কিন্তু ক্ষয়-ক্ষতি নিরূপণের জন্য বিশেষজ্ঞ কমিটি ব্যবহার করা হয়নি।
তিনি বলেন, প্রাথমিকভাবে যে প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে সেখানে সৃজিত বন, প্রাকৃতিক বন ও আর জীববৈচিত্রের মূলত তিনভাগে ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারণ করা হয়েছে।
তবে নতুন করে ক্ষয়ক্ষতি নির্ধারণের জন্য গঠিত উক্ত বিশেষজ্ঞ কমিটি এখনও কাজ শুরু করেনি বলে জানা যায়।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে এই কমিটির অন্যতম সদস্য (জেলা প্রশাসকের প্রতিনিধি), উখিয়ার সহকারী কমিশনার (ভ‚মি) আমিনুল এহসান খান বলেন, এ বিষয়ে আমাকে কিছুই জানানো হয়নি।
কমিটির অন্যতম সদস্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্সটিটিউট অব ফরেস্ট্রি এন্ড এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্সেসের অধ্যাপক, বনসম্পদ অর্থনীতি বিশেষজ্ঞ ড. মো. দানেশ মিয়া বিশেষজ্ঞ কমিটিতে তাঁকে রাখার বিষয়টি অবগত হলেও এখনও কমিটির কোন বৈঠক হয়নি বলে জানান। আর তাই কবে নাগাদ এই কমিটি কাজ শুরু করতে পারবে তাও তিনি নিশ্চিত নন।
এ প্রসঙ্গে জানতে কমিটির অন্যতম সদস্য ও চট্টগ্রাম অঞ্চলের বন সংরক্ষক আবদুল আউয়াল সরকার দৈনিক আজাদীকে বলেন, বন অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে ওই বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করে তা অনুমোদনের জন্য মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। অনুমোদন পাওয়া গেলেই কাজ শুরু করে দেবে কমিটি।
কমিটির প্রধান, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্সটিটিউট অব ফরেস্ট্রি এন্ড এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্সেসের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ কামাল হোসাইন এ প্রসঙ্গে বলেন, প্রকৃতিতে একটি গাছের পানি ধরে রাখা, মাটি ধরে রাখা, খাদ্য উৎপাদন, অক্সিজেন উৎপাদন ও কার্বন শোষণসহ নানা মাপকাঠিতে পরিবেশগত অর্থনৈতিক মূল্যায়ন নির্ধারণ করা হয়।
পরিবেশ বিশেষজ্ঞ রাগিবউদ্দিন রোহিঙ্গা ক্যাম্পের কারণে ধ্বংস হওয়া বনাঞ্চলে কত প্রজাতির পশু-পাখি ও অন্যান্য প্রাণী ছিল, তা এখনও নিরূপণ করা সম্ভব না হলেও বনাঞ্চলটি টেকনাফ গেম রিজার্ভের অংশের মতোই জীব বৈচিত্রে ভরপুর ছিল বলে জানান।
টেকনাফ গেম রিজার্ভে ২৯০ প্রজাতির উদ্ভিদ, ৫৫ প্রজাতির স্তন্যপায়ী, ২৮৬ প্রজাতির পাখি, ৫৬ প্রজাতির সরীসৃপ এবং ১৩ প্রজাতির উভচর প্রাণী রয়েছে বলে ইত:পূর্বে করা বিভিন্ন জরীপে উল্লেখ করা হয়েছে। রোহিঙ্গা ক্যাম্পের জন্য ধ্বংস হওয়া বনাঞ্চলেও টেকনাফ গেম রিজার্ভের মতোই কমবেশি বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণীর আবাসস্থল ছিল বলে মনে করেন পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা।
বিজ্ঞানী রাগিবউদ্দিন বলেন, বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখার মধ্যে পরিবেশ অর্থনীতি বিষয়টি অনেক ব্যাপক ও জটিল। কোন প্রাণীর পরিবেশগত অর্থনীতির মূল্যায়নের বিষয়টিও অনেক কঠিন। মানবকল্যাণে প্রাণীকূলের ব্যবহার সম্পর্কে গবেষণার মাধ্যমে দিন দিন নতুন নতুন তথ্য জানা যাচ্ছে। সর্বশেষ প্রাপ্ত গবেষণা তথ্য অনুযায়ী বিভিন্ন প্রাণী ও গাছের পরিবেশগত অর্থনৈতিক গুরুত্বের কথা হিসাব করলে প্রকৃত ক্ষতির বিষয়টি জানা যাবে।
রোহিঙ্গা ক্যাম্পে জীববৈচিত্র ধ্বংসের কারণে শুধু উখিয়া-টেকনাফের মানুষ নয়, পুরো কক্সবাজার জেলার মানুষ এমনকি সারাদেশের পরিবেশগত অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে বলে মনে করেন বিজ্ঞানীরা।
বিজ্ঞানী রাগিবউদ্দিন দেশের যেকোন উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণের আগে পরিবেশগত লাভক্ষতির সমীক্ষা করা উচিৎ মন্তব্য করে বলেন, ভিয়েতনামের জলবিদ্যুৎ প্রকল্প থেকে একটি ১৩২ কেভি ক্ষমতা সম্পন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ লাইনের মাধ্যমে থাইল্যা্ন্ডে বনভূমির উপর দিয়ে বিদ্যুৎ আনতে হবে, এ কারণে ১৯৯২ সালে সেদেশের সরকার প্রকল্পটি থেকে সরে এসেছিল। পরিবেশ সমীক্ষায় দেখা গিয়েছিল, ভিয়েতনাম থেকে বিদ্যুৎ আনতে গিয়ে এর বিদ্যুৎচুম্বকীয় তরঙ্গের কারণে মৌমাছির মধু উৎপাদনে যে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে তার ক্ষতি লাভের চেয়ে তিনগুণ।
পাঠকের মতামত: